আশরাফ আলী সোহান: নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে ধর্মভিত্তিক ১৩ দলের তিন রকম মনোভাব

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে ধর্মভিত্তিক ১৩ দলের তিন রকম মনোভাব

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোতে। জামায়াতে ইসলামীসহ বিএনপির ঘনিষ্ঠ দলগুলো প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) নতুন কমিশনকে নিয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আর সরকারের ঘনিষ্ঠ দলগুলো এ কমিশনে সন্তুষ্ট, আশাবাদী। এ দুই ঘরানার বাইরে ধর্মভিত্তিক কিছু দল আছে, তারা নতুন কমিশনের ব্যাপারে অনেকটাই নির্লিপ্ত।

ইসলাম ধর্মভিত্তিক ১৩টি দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। নির্লিপ্ত দলগুলোর মধ্যে চরমোনাই পীর সাহেবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও হাফেজ্জি হুজুর রহ. প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এই দল তিনটিও নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। অতীতের জাতীয় নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতের পরেই অবস্থান ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। এই দল এবার নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপেও অংশ নিয়েছিল। নতুন কমিশন গঠনের পর ছয় দিন পার হয়েছে, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে ভালো-মন্দ কিছুই বলেনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনূছ আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন কমিশন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো জরুরি মনে করিনি।’ অবশ্য দলের আমির চরমোনাই পীর সাহেবের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আশরাফ আলী আকন বলেছেন, ‘আমরা ধোঁয়াশার মধ্যে আছি। এখন আমরা দেখব, নির্বাচন কমিশন কী করে। এরপর পদক্ষেপ নেব।’ অবশ্য দলটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেছেন, তাঁরা সংলাপে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান কমিটি করার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু অনুসন্ধান কমিটিকে ‘নিষ্কলুষ’ মনে হয়নি, এ কারণে দলটি কমিটিতে কোনো নামের তালিকা দেয়নি।

একসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে ছিল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। দলটির মহাসচিব (শায়খুল হাদীস রহ. এর ছেলে) মাও. মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ইসির ব্যাপারে আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাইনি। শনিবার রাতে নির্বাহী কমিটির বৈঠকের পর জানাব।’ খেলাফত আন্দোলনের দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, কমিশন গঠনের পর দলের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে কোনো এক জায়গা থেকে ফোন আসায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রতিক্রিয়া না জানানোর সিদ্ধান্ত দেন।

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোতে আলোচিত ইসলামী ঐক্যজোট গত বছরের জানুয়ারিতে বিএনপির জোট ছেড়ে আসে। মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর এই দল নতুন নির্বাচন কমিশনের সাফল্য কামনা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। এই দলও বিএনপির সঙ্গে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন যে ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা এমনই করে। ইসিকে আমি খুব গুরুত্ব দিই না। সরকার ও প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে কেবল ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব না।’

সরকার-সমর্থক ধর্মভিত্তিক দলগুলো নতুন নির্বাচন কমিশনের ওপর সন্তুষ্ট। এর মধ্যে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামা (মাসউদ) ও বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট (মিছবাহুর) উল্লেখযোগ্য। নবনিযুক্ত সিইসি কে এম নুরুল হুদার নাম অনুসন্ধান কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক তরিকত ফেডারেশন। দলটির মহাসচিব এম এ আউয়াল প্রথমআলোকে বলেন, ‘আমরা আশাবাদী, নতুন নির্বাচন কমিশন সব রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজকে আস্থায় রেখে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে।’ ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মহাসচিব জয়নুল আবেদীন জুবাইর বলেন, ‘আমরা তো নতুন ইসিকে ইতিবাচকভাবে দেখি। ওনারা ভালোভাবেই কাজ করবেন, এই আস্থা রাখি। ’আর বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এম এ মতিন বলেন, নতুন যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাঁরা কে কোন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; দায়িত্বে আসার পর তাঁরা কোনো দলের পক্ষে কাজ করছেন কি না, সেটা দেখার বিষয়।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে জামায়াতসহ চারটি ইসলামপন্থী দল আছে। বিএনপির মতো এই দলগুলোও মনে করে, নবনিযুক্ত সিইসি নিরপেক্ষ নন। তিনি বিতর্কিত, অনভিজ্ঞ এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ।  তাঁর নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশনের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে এসব দল হতাশা ব্যক্ত করেছে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছে, নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তা আবারও প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশ জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি আবদুর রব ইউসুফী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরিজীবনে যে সরকারি কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করেছেন, যাঁর আইন ভাঙার অভ্যাস আছে, এমন ব্যক্তি সিইসি হয়ে যে নির্বাচন কমিশনের আইন মানবেন, তা কী আশা করা যায়?’ বিএনপি জোটে থাকা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের ধারণা, আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চায়। এ লক্ষ্যে অত্যন্ত সন্তর্পণে তারা নির্বাচন কমিশন গঠন করিয়েছে।

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, নবনিযুক্ত ইসির সদস্যরা মুখে বলেছেন, তাঁরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এখন জনগণ দেখবে, তাঁদের কথা ও কাজে কতটা মিল থাকে।

 

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন